মার্চের এক রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে গাজীপুরে একটি আধুনিক ভবনের বড় ফটকের সামনে বেশ কয়েকজনকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল।
তাদের ‘স্বাস্থ্যবিধি’ নিশ্চিত করা হচ্ছিল। এটি খাবারের মান নিশ্চিতের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। কর্মীরা কারখানায় ঢোকার আগে জুতা বদল করে ও হাত ধুয়ে অ্যাপ্রোন পরে নেন।
এটি ছিল দেশের অন্যতম জনপ্রিয় মিষ্টির দোকান প্রিমিয়াম সুইটসের এক কারখানার দৃশ্য।
সম্প্রতি পণ্যের গুণমান নিশ্চিত করতে পৃথক উৎপাদন ও গবেষণা ইউনিটসহ ছয়তলাজুড়ে ৩০০ কর্মীর কারখানাটি ঘুরে দেখা হয়। সেখানে পোকা মারার প্রযুক্তিরও দেখা মেলে।
মান নিয়ন্ত্রণের অংশ হিসেবে এখানে এমন যন্ত্র ব্যবহার করা হয়, যা ময়দাসহ অন্যান্য কাঁচামাল থেকে ক্ষতিকারক উপাদান সরিয়ে দেয়। এভাবে উৎপাদিত পণ্যে ক্ষতিকর কিছু না থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়।
কারখানাটি সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকে। একদল শ্রমিক মিষ্টি তৈরিতে ও অন্য দলকে রান্নাঘরে কাজ করতে দেখা যায়। অনেকে ছিলেন পণ্যের প্যাকেজিং ও ফ্রিজিংয়ের কাজে।
যদি আপনার আশেপাশের কোনো মিষ্টির দোকানে যান এবং কারখানার ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখেন যে সেখানে কীভাবে কাজ হয়, তাহলে দেখবেন অনেক ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি মানা হচ্ছে না। আবার কোথাও তা একেবারেই উপেক্ষিত।
তবে প্রতিযোগিতা যতই বাড়ছে ততই পাল্টে যাচ্ছে কারখানার কাজের ধরন। অনেক কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান উন্নতমানের মিষ্টির আউটলেট খুলেছে। যেসব দেশে প্রচুর সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশি থাকেন, সেখানে অনেক প্রতিষ্ঠান মিষ্টি রপ্তানি করছে।
নামকরা প্রতিষ্ঠানগুলো উত্পাদন প্রক্রিয়াকে স্বয়ংক্রিয় করেছে। যেমন, ‘রস মালাই’ প্রতিষ্ঠানটি প্রযুক্তির সহায়তায় পুরো উৎপাদন প্রক্রিয়াটি ঢেলে সাজিয়েছে। আগে শ্রমিকরা হাত দিয়ে মিষ্টির আকার দিতেন। এখন প্রতিটি মিষ্টির আকার মেশিনের মাধ্যমে দেওয়া হয়।
এ ছাড়া, আরও নানাভাবে মান বজায় রাখা হচ্ছে। প্রিমিয়াম সুইটসের হেড অব বাংলাদেশ অপারেশনস মাহবুবুর রহমান বকুল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমরা একবার ব্যবহার করা তেল আবার ব্যবহার করি না।’
প্রিমিয়াম সুইটস ১০০’র বেশি মিষ্টি ও ১৫টির বেশি বেকারি পণ্য উত্পাদন করে। মিষ্টির দাম প্রতি কেজি ৬৫০ টাকা থেকে এক হাজার টাকা। বিশেষ মিষ্টির দাম সাড়ে তিন হাজার টাকা।
প্রিমিয়াম সুইটসের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী এইচ এম ইকবাল ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘অনেকে ব্র্যান্ডের মিষ্টি পছন্দ করেন। কারণ, এখানে নানান ধরনের ও ভালো স্বাদের মিষ্টি পাওয়া যায়। স্বাস্থ্যবিধিও মেনে চলা হয়।’
বাংলাদেশে এর ১৩, কানাডায় পাঁচ ও যুক্তরাষ্ট্রে একটি আউটলেট আছে।
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা কানাডার প্রতিটি প্রদেশে মিষ্টি বিক্রি করি। ২০৩০ সালের মধ্যে পাঁচ মহাদেশে আমাদের ব্যবসা বাড়ানোর পরিকল্পনা আছে।’
প্রিমিয়াম সুইটসের মতো ‘মিঠাই’, ‘রস সুইটস’, ‘ওয়েল ফুড’, ‘বনফুল সুইটস’ ও বিক্রমপুর মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মতো বেশ কয়েকটি দেশি মিষ্টির প্রতিষ্ঠান আছে।
২০১৫ সালে প্রাণ গ্রুপ ঢাকায় ‘মিঠাই’ ব্র্যান্ডের ৪০টি দোকান চালু করে। প্রতিষ্ঠানটির মার্কেটিং ডিরেক্টর কামরুজ্জামান কামাল ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত ভালো আয় হচ্ছে। সর্বোত্তম মান ও স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা হচ্ছে।’
‘সবাই দুধ দিয়ে মিষ্টি বানান। যাই হোক, যখন দুধের কথা আসে, তখন গ্রাহকরা জানতে চান যে এটি কীভাবে সংগ্রহ করা হয়। তাই যখন কোনো কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান মিষ্টি তৈরি করে, তখন ক্রেতারা আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেন,’ যোগ করেন তিনি।
২০০১ সালে ওয়েল গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ওয়েল ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কোম্পানি লিমিটেড চট্টগ্রামের জিইসি সার্কেলে আউটলেট খুলে যাত্রা শুরু করে।
১৯৭৩ সালে ওয়েল গ্রুপ প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে এটি খাবার তৈরি করে জনপ্রিয়তা পায়। ওয়েল ফুডে এখন প্রায় তিন হাজার কর্মী আছে।
গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ নুরুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমরা যখন বেকারির ব্যবসা শুরু করি তখন শখের বশে খাবার তৈরির আলাদা বিভাগ খুলি। শেষে মিষ্টির ব্যবসায় আসি।’
তার মতে, দেশে মিষ্টি ব্যবসার করপোরেট বাজার ভালো।
চট্টগ্রাম, ঢাকা ও সিলেটে ওয়েল ফুডের ১১০টি আউটলেট আছে।
আরেক জনপ্রিয় ব্র্যান্ড হলো জেমকন গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান মীনা সুইটস। রাজধানীতে এর ২২টি আউটলেট আছে।
মীনা সুইটসের চিফ অপারেটিং অফিসার আহমেদ শোয়েব ইকবাল ডেইলি স্টারকে বলেন ‘বাজারের বেশিরভাগ মিষ্টিতে গুঁড়ো দুধ দেওয়া হয়। এর স্বাদ ভিন্ন। আমরা ডেইরি ফার্ম থেকে দুধ নিই।’
‘বাংলার মিষ্টি’র আউটলেটে অন্তত ৩৫ জেলার জনপ্রিয় মিষ্টি বিক্রি হয়। যেমন—মুক্তাগাছার মণ্ডা, নেত্রকোনার বালিশ, চাঁপাইনবাবগঞ্জের পোস্তো-কদম ও শাহজাদপুরের রাঘবসাই কেনা যায়।
ঢাকার মিষ্টির বাজারে প্রভাবশালী নাম মরণ চাঁদ, আলাউদ্দিন সুইটমিট, আলীবাবা সুইটস, বিসমিল্লাহ সুইটস, মুসলিম সুইটমিট ও আল-ইসলামিয়া সুইটস। তবে এখন তাদের অবস্থা আগের মতো নেই।
একদিকে যেমন অনেক ক্রেতা ব্র্যান্ডের দিকে ঝুঁকছেন; অন্যদিকে, অনেক প্রতিষ্ঠান মালিকানা জটিলতায় দুর্বল হয়ে পড়েছে।
১৯৮৩ সালে শুরু হয় আলাউদ্দিন সুইটমিট। এরপর সারা দেশে বেশ কয়েকটি আউটলেট খোলা হয়। অচিরেই এর স্বত্বাধিকারী হাজী মাসুম উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ব্যবসাকে লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত করেন। পরে বিদেশে একাধিক শাখা খোলেন।
প্রতিষ্ঠানটির সাফল্য বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। বর্তমানে হাজী মাসুমের জামাতা মো. মারুফ আহমেদ আলাউদ্দিন এগ্রো ফুড প্রোডাক্টস কোম্পানি নামে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।
হাতেগোনা যে কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী মিষ্টির দোকান এ ধরনের ঝামেলা থেকে মুক্ত তাদের একটি বনফুল অ্যান্ড কোং। বর্তমানে ঢাকায় এর ৮৯টিসহ সারাদেশে ১৭০টি আউটলেট আছে। লন্ডন ও দুবাইয়েও এর স্টোর আছে।
বাংলাদেশে মিষ্টির দোকানের সঠিক সংখ্যা পাওয়া দুষ্কর। বনফুলের পরিচালক ও বাংলাদেশ সুইট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি দেদারুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সঠিক পরিসংখ্যান জানতে শিগগিরই জরিপ চালানোর পরিকল্পনা আছে।’
সংশ্লিষ্টদের ধারণা, মিষ্টির বাজারের আকার প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা।